The Oedipus Complex [শিহাব আহমেদ তুহিন]

The Oedipus Complex
.
থেবেস নগরীতে কোনো কিছুরই অভাব নেই। তারপরেও রাজা লুইস আর তার স্ত্রী জকোস্টার মনে কোনো সুখ নেই। কারণ, তারা নিঃসন্তান। বহু বছর সন্তানহীন থাকার পর লুইস এক গণকের সাহায্য নিলেন। গণক ভবিষ্যৎবাণী করলো যে, রাজা লুইসের যদি কোনো পুত্র সন্তান জন্মায়, তবে সে তাকে হত্যা করবে আর নিজের মাকে বিয়ে করবে। দুঃখজনকভাবে, সে বছরেই তাদের একটি পুত্রসন্তান হলো। প্রফেসীটা ঠেকাতে রাজা লুইস ছেলেটার গোড়ালী কেটে ফেললেন যাতে ছেলেটা হামাগুড়িও না দিতে পারে। তারপর জকোস্টা ছেলেটাকে এক চাকরের হাতে তুলে দিলেন। চাকরটাকে নির্দেশ দিলেন ছেলেটাকে হত্যা করার জন্য।
.
কিন্তু এই নিষ্পাপ ছেলেটাকে হত্যা করতে লোকটার মন সায় দিলো না। তাই সে ছেলেটাকে এক রাখালের হাতে তুলে দিলো। পরবর্তীতে কয়েক হাত পালাবদল হয়ে, ছেলেটা শেষ পর্যন্ত পলিবাসের মহলে আশ্রয় পেলো। পলিবাস ছিলেন থেবেস এর প্রতিবেশী নগরী করিন্থ এর রাজা। রাজা আর রাণী ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতই লালন-পালন করতে লাগলেন আর তার নাম রাখলেন “ইডিপাস” ।
.
ইডিপাস খুব সুখেই রাজমহলে বড় হতে থাকলো। কিন্তু যুবক বয়সে হঠাৎ এক মাতাল তাকে “জারজ” বলে গালি দিলো। মাতালটা তাকে আরো জানালো, ইডিপাস রাজা পলিবাসের নিজের সন্তান না। ইডিপাস তার বাবা মাকে ঘটনার সত্যতা জিজ্ঞেস করলে তারা তা অস্বীকার করলেন। সত্যটা জানতে ইডিপাস এক গণকের আশ্রয় নেয়। গণক তাকে শুধু এতোটুকু বলে যে, ইডিপাস নিজের বাবাকে হত্যা করবে আর নিজের মাকে বিয়ে করবে। এমন কুৎসিত পরিণতি এড়াতে, ইডিপাস করিন্থ নগরী থেকে পালিয়ে যায়।
“বিধির লিখন, যায় না খন্ডন”- বলে একটা কথা আছে। না হলে কেন ইডিপাস করিন্থ নগরী ছেড়ে নিজের জন্মভূমি থেবেসেই ফিরে আসবেন? থেবেসে আসার পরপরই সে এক রথের সামনে পড়ে আর রথের চালকের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ঝগড়া এমন পর্যায়ে পৌছায় যে, ইডিপাস চালকটাকে হত্যা করে ফেলে। দুঃখজনকভাবে, সেই চালকটাই ছিলেন থেবেসের রাজা লুইস, ইডিপাসের জন্মদাতা। এভাবে নিজের জন্মদাতাকে হত্যা করে ইডিপাস ভবিষ্যৎবাণী আংশিক পূর্ণ করে ফেললো নিজের অজান্তেই। এক চাকর লুইসকে রাস্তায় মৃত দেখতে পেয়ে রাজমহলে অবহিত করলো। পুরো থেবেস নগরীতে শোকের ছায়া নেমে আসলো।
.
থেবেসের পথ চলতে চলতে ইডিপাস এক স্ফিংক্স (নারীর মুখ ও সিংহের দেহবিশিষ্ট দানাওয়ালা দানব) এর সামনে পড়লো। স্ফিংক্স পথিকদের ধাঁধা জিজ্ঞেস করতো। সঠিক উত্তর দিতে পারলে তাদের ছেড়ে দিতো আর ভুল উত্তর দিলে তাদের হত্যা করতো। দানবটা তাকে জিজ্ঞেস করলো, “কোন প্রাণী সকালে চার পায়ে, বিকেলে দুই পায়ে আর রাতে তিন পায়ে হাঁটে?” ইডিপাস উত্তর দিলো- “মানুষ”। শৈশবে তারা চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে, পরিণত অবস্থায় দুইপায়ে আর বৃদ্ধাবস্থায় দুই পা আর লাঠি অর্থাৎ তিন পায়ে। ওডিপাসের উত্তর সঠিক হলো। দানবটা তাকে কাঁধে নিয়ে থেবেস ঘুরালো। থেবেসের সবাই অবাক হয়ে তা দেখলো, কারণ ইডিপাসই প্রথম এই দানবটার কাঁধে চড়তে পেরেছে।
.
এদিকে রাজার মৃত্যুতে রাণী জকোস্টার ভাই ঘোষণা করেছিলেন, যে স্ফিংক্স এর কাঁধে চড়তে পারবে তাকেই থেবেসের রাজা ঘোষণা করা হবে। তাই ওডিপাসকে থেবেসের রাজা ঘোষণা করা হলো আর রাজার বিধবা স্ত্রী জকোস্টার সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হলো। তাদের সন্তান ও হলো। এভাবে ইডিপাস পুরো ভবিষ্যৎবাণী পূর্ণ করলো- “ছেলেটা নিজের বাবাকে হত্যা করবে আর নিজের মাকে বিয়ে করবে।”
.
বিয়ের কয়েক বছর পর রাজ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়লো। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। এ অবস্থা ঠেকাতে রাজা ইডিপাস এক গণকের আশ্রয় নিলো। গণক জানালো, যদি রাজা লুইসের হত্যাকারীর শাস্তি হয় তবে নগরীতে শান্তি ফিরে আসবে। হত্যাকারীকে পরিচয় জানতে ইডিপাস থেবেসের ভাববাদী টায়ারসিয়াস এর সাহায্য চাইলো। টায়ারসিয়াস তাকে তিরস্কার করলো আর তাকে রাজা লুইসের হত্যাকারীকে খুঁজতে নিষেধ করলো। ইডিপাস আরো জানতে পারলো, এ নগরীতে দুর্ভিক্ষের কারণ হচ্ছে এখানে এক ব্যক্তি নিজ বাবাকে হত্যা করেছে আর মাকে বিয়ে করেছে। করিন্থ নগরীতে থাকা অবস্থায় শোনা ভবিষ্যৎবাণীটা ইডিপাসের মনে পড়ে গেলো। সে করিন্থ নগরীতে দূত পাঠিয়ে জানতে পারলো রাজা পলিবাস মারা গিয়েছেন।
.
পিতার মৃত্যুর সংবাদ শুনেও ইডিপাস স্বস্তি বোধ করলো। কারণ, এখন তো আর ভবিষ্যৎবাণী পূর্ণ হওয়া সম্ভব না। দূত তাকে আরো জানালো যে, সে জানতে পেরেছে- ইডিপাস রাজা পলিবাসের পালক সন্তান ছিলো। এ কথা শুনে ইডিপাস ধাঁধায় পড়ে গেলো। কারণ, রাণী জকোস্টা তাকে একবার বলেছিলো যে, রাজা লুইস আর রাণী জকোস্টা তাদের একমাত্র সন্তানকে এক চাকরের হাতে তুলে দিয়েছিলো। এদিকে রাণী জকোস্টা যখন সব শুনলেন আর ইডিপাসের গোড়ালীর দিকে তাকালেন তিনি সব বুঝতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ইডিপাস আসলে তার আপন ছেলে। তিনি ইডিপাসকে নিষেধ করলেন, সে যাতে ব্যাপারটা নিয়ে আর না ঘাটায়। কিন্তু ইডিপাস থেমে গেলো না। যে চাকরটার হাতে রাণী জকোস্টার ছেলেকে তুলে দেয়া হয়েছিলো, ইডিপাস তাকে ডেকে পাঠালো। আর তার মাধ্যমেই সে জানতে পারলো, পলিবাসের পালকসন্তান আর রাণী জকোস্টার পরিত্যক্ত সন্তান একই ব্যক্তি। ইডিপাস নিজে!
.
রাণী জকোস্টা তীব্র লজ্জায় আত্নহত্যা করলেন। ইডিপাস মৃত মায়ের সামনে আসলো। আর কাঁদতে কাঁদতে বললো, “তুমি আমার মা! আর আমার চোখ কিনা তোমাকে কামনার দৃষ্টিতে দেখেছে!” অনুশোচনায় ইডিপাস নিজের চোখ মায়ের নেকলেস দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে অন্ধ করে ফেললো। চলে গেলো নির্বাসনে।
.
গল্পটা গ্রীক পুরাণ থেকে নেয়া। সত্য নাকি মিথ্যা জানার উপায় নেই। ১৮৮০ সালে এ ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে একটি মঞ্চ-নাটক প্রদর্শিত হয়। নাটকটি বেশ ব্যবসা সফল হয়। যা সেসময়কার বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে বেশ প্রাভাবিত করে।
.
মনোবিজ্ঞানে সিগমুন্ড ফ্রয়েড বেশ বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত!) নাম। তিনি প্রায় সবকিছুই ব্যাখ্যা করতেন যৌনতা দিয়ে। এমনকি একটা ছেলে ছোটবেলা খেলনার প্রতি আকৃষ্ট হয়, এটাও তিনি যৌনতা দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন। ফ্রয়েড দাবী করতেন সকল সামাজিক সম্পর্কই যৌনতাকেন্দ্রিক[১]।
.
ওডিপাসের গল্প থেকে তিনি এই উপসংহার টানেন যে, সকল ছেলেই তার মাকে কামনার বস্তু মনে করে। যার কারণে, তারা তাদের বাবার প্রতি হিংসা অনুভব করে। তিনি এটার নাম দেন “ইডিপাস কমপ্লেক্স”। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা এতোটাই হাস্যকর এবং বিকৃত যে, অনেক বিবর্তনবাদীরাও তার এইসব উদ্ভট ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেনি। তাদের মতে ফ্রয়েড কোনো বিজ্ঞানী নয় বরং “গল্পকার”।
.
সমকামিতা প্রমাণের ক্ষেত্রে, অনেকের কাছেই ডারউইনের বিবর্তনবাদ শক্ত একটা দলিল। তাদের যুক্তি হচ্ছেঃ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের পূর্বপুরুষ একই হবার কারণে আচরণে আর প্রবৃত্তিতে অন্যান্য প্রাণীদের থেকে মানুষের খুব বেশী পার্থক্য নেই। তাই যদি পশুদের মধ্যে সমকামিতা থাকে, আমরা কেন তা করতে পারবো না? ঠিক একইভাবে প্রাণীদের মধ্যে যদি ইনসেস্ট বা অযাচার বিদ্যমান থাকে, তবে আমাদের তা করতে সমস্যা কি? সমকামিতা এখন পাশ্চাত্যে মোটামুটি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই বিকৃত যৌনাচারের যুগেও বহু মানুষ ইনসেস্টকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। কারণ, দিনশেষে বিকৃতিরও তো একটা সীমা আছে। তাই ইনসেস্টকে বলা হয় “The last taboo”। কিছু বিকৃত মানুষ দাবী করে, এই স্বাভাবিক(!) প্রবৃত্তিকে স্বীকার করে নিতে পারলে নাকি আমরা পুরোপুরি মুক্ত হতে পারবো।
.
এদের জন্য আশার বাণী রেখে সম্প্রতি, স্পেন আর রাশিয়া পারষ্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ইনসেস্টকে বৈধতা দিয়েছে[২]। জার্মানী ভাই-বোনের অযাচারকে বৈধতা দিয়েছে[৩]। আমেরিকাও বৈধতা দেয়ার পথে আগাচ্ছে।
.
অযাচারের ক্ষেত্রে, বিকৃতমনাদের খুব প্রিয় একটা যুক্তি হচ্ছে- “ If animals can do it, why can’t we?”
প্রথমত, বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন কিছু কিছু নৈতিকতা শুধুমাত্র মানুষের জন্যই। আমরা যখন পশুদের আচরণের কথা বলি, তখন আমরা কখনোই “ধর্ষণ” কিংবা “বিয়ে” এই টার্মগুলো ব্যবহার করি না। এগুলো শুধুমাত্র মানুষের জন্যই স্বতন্ত্র।
দ্বিতীয়ত, প্রাণিজগতে ইনসেস্ট স্বাভাবিক, এটি একটি অসত্য কথা। জীববিজ্ঞানীরা বলেন, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রাণিজগতে ইনসেস্ট একটি বিরল ঘটনা[৪]।
তৃতীয়ত, এমনকি প্রাণিদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি রয়েছে যে, তারা রক্তের সম্পর্কের কারো সাথে মিলিত না হয়ে দূরবর্তী কারো সাথে মিলিত হতে চায়। এটাকে বলা হয়, “Sexual imprinting”[৫] ।
.
উইকিপিডিয়াতে, ইনসেস্টের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে কাজিনদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী একেবারে পরিষ্কার। আমরা বলি, কাউকে আমাদের ভাই অথবা বোন হতে হলে অন্তত আমাদের বাবা কিংবা মা এক হতে হবে। জাহেলী যুগে, আরবদের একটি কালচার ছিলো। পিতা মারা গেলে পিতার স্ত্রী ছেলের অধিকারে চলে যেতো। এমনকি, সে সময়ে মিশর, ইরান ইত্যাদি দেশে অযাচার বিদ্যমান ছিলো। রাজারা নিজ কন্যাদের বিয়ে করতেন [৬] । আল্লাহতায়ালা কুর’আনে পরিষ্কারভাবে এসব নিষিদ্ধ করেনঃ
.
“যে নারীকে তোমাদের পিতা-পিতামহ বিবাহ করেছে তোমরা তাদের বিবাহ করো না। কিন্তু যা বিগত হয়ে গেছে। এটা অশ্লীল, গযবের কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।
তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভ্রাতৃকণ্যা; ভগিনীকণ্যা তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সাথে সহবাস করেছ সে স্ত্রীদের কন্যা যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সাথে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গোনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকরী, দয়ালু।” ( সূরা নিসাঃ ২২-২৩)
.
বাইবেলেও ইনসেস্টকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে[৭]। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একইসাথে, বাইবেলে দশটিরও বেশী অযাচারের গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
— লূত(আঃ) এর দুই মেয়ে তাদের বাবাকে পরপর দুইরাত মদ পান করায় এবং বাবার সাথে মিলিত হয়। ফলে, মেয়ে দুইটি বাবার দ্বারা গর্ভবতী হয়ে পড়ে[৮]।
— ইব্রাহীম(আঃ) আর তাঁর স্ত্রী সারাহ এর বাবা একই ব্যক্তি ছিলেন। যার অর্থ, সারাহ ছিলেন ইব্রাহীম(আঃ) এর সৎ বোন[৯]।
— দাউদ(আঃ) এর বড় ছেলে এবং সিংহাসনের উত্তরসূরী অম্নোন, তার বোন তামারকে ধর্ষণ করে[১০]। দাউদ(আঃ) এর আরেক ছেলে অবশোলম তার পিতার সাথে বিদ্রোহ করে খোলা আকাশের নীচে পুরো ইসরায়েলবাসীর সামনে তার পিতার উপপত্নীদের ধর্ষণ করে[১১]।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমাদের মুসলিমদের আকিদা হচ্ছে, সকল নবীরাই নিষ্পাপ ছিলেন। যদি এমন কোনো কিছু কোনো পূর্ববর্তী কিতাবে উল্লেখ করা হয় যা নবীদের চরিত্রকে কুলষিত করে, তবে তা বিকৃত এবং বানোয়াট।
.
বর্তমানে নাস্তিকসহ অনেকেই প্রশ্ন তুলে, যদি ধর্মগ্রন্থের পবিত্র ব্যক্তি আর তাদের সন্তানেরা এসব করতে পারে আর ঈশ্বর সেটা তাঁর কিতাবে উল্লেখও করতে পারেন, তবে আমাদের এসব করতে সমস্যা কি? বর্তমানে তাই পাশ্চাত্যে ইনসেস্ট ভয়াবহ আকারে বাড়ছে।
বেশী না, পঞ্চাশ বছর আগেও সবাই সমকামিতার মত ইনসেস্টকেও একটি বিকৃত যৌনাচার হিসেবে জানতো। পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৫৫ সালে আমেরিকাতে প্রতি মিলিয়নে কেবল একজন মানুষ অযাচারে লিপ্ত হতো[১২]। আর এখন? প্রতি তিনটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে আর প্রতি পাঁচটি ছেলের মধ্যে একটি ছেলে তাদের বয়স ১৮ হবার পূর্বেই পরিবার কর্তৃক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়[১৩]।
.
আচ্ছা, আমাদের এখানে কি অবস্থা? NDTV এর একটি রিপোর্টে প্রতিবেশী দেশ ভারতে অযাচারের একটি পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে[১৪]। পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতে ৫৩% শিশু শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়। ৭২% শিশুকে নীরবে এই লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। ৬৪% অযাচারের শিকার শিশুদের বয়স ১০-১৮ বছর। ৩২% এর বয়স কেবল ২-১০। চিন্তা করা যায়? মাত্র দুই থেকে দশ! যারা এই অযাচারের শিকার হয় তাদের ৮৭% কে বারবার এই শারীরিক লাঞ্ছনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
.
যারা আমার এই লিখা পড়ে এতোক্ষণ “এমন বিকৃত টপিক নিয়ে কেন লিখছি!” এমনটা ভাবছিলেন তাদের জন্য এই পরিসংখ্যানগুলো দেয়া। কয়েক বছর আগেও এমন বিকৃত কিছু যে মানবসমাজে থাকতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। আর সত্যি বলতে যে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের নিকট এসব বিকৃত মনে হবে। আমি প্রথম ইনসেস্ট টার্মটার সাথে পরিচিত হই, বর্তমান সময়ে নাস্তিকদের নবী লরেন্স ক্রাউসের সাথে হামজা জর্জিসের এক ডিবেটে[১৫]। বিতর্কের এক পর্যায়ে, হামজা জর্জিস, লরেন্স ক্রাউসকে প্রশ্ন করেনঃ
.
“Why is incest wrong?” ( অযাচার কেন ঠিক নয়? )
লরেন্স ক্রাউস জবাব দেন, “ It’s not clear(to) me that it’s wrong.” (আমার কাছে মনে হয় না যে এটা খারাপ কিছু।)
.
আমি জবাব শুনে থ’ হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, পৃথিবীতে এমনো মানুষ থাকতে পারে যারা এটাকে বৈধ মনে করতে পারে। বিতর্কের পর নাস্তিকদের সেরা নবী রিচার্ড ডকিন্স তার টুইটার একাউন্টে উত্তরটি শেয়ার করে তার সম্মতি প্রকাশ করেন[১৬]।
.
আমাদের বাংলাদেশে কি অবস্থা? মিডিয়াতে যাদেরকে বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনষ্ক(!) চিন্তাভাবনার রাজপুত্র বলা হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- আসিফ মহিউদ্দিন, অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার ওরফে থাবা বাবা। আমার কাছে প্রমাণ রয়েছে, এরা সবাই তাদের বিভিন্ন লেখায় অযাচারকে প্রমোট করেছেন।
.
এছাড়া বঙ্গদেশীয় নাস্তিকদের ধর্মীয়গ্রন্থ “মুক্তমনা” ব্লগে আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে আদনান নামে এক ব্লগার “নষ্ট রাত্রি” নামে একটি ছোটগল্প লিখেন[১৭]। তাতে কল্পনার অযোগ্য বিকৃতিতে লেখক বাবাকে নিয়ে দুই মেয়ের ফ্যান্টাসির কথা লিখেছেন। পুরো গল্পটিতে আসলে কি ছিলো সেটি আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। আমার রুচিতে কুলোচ্ছে না। লেখক তার অশ্লীল গল্পটাকে বিশেষায়িত করেছেন এভাবেঃ
.
“গল্পটি আসলে ক্ষীণদৃষ্টি, বিশ্বাসের দাসত্ব, আর নষ্টামির বিরুদ্ধে আমার, আপনার, ও আমাদের একটা সংগ্রাম। আর গল্পটি বলাও হয়েছে শিশ্নটির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কয়েকবার পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন যে মানুষ ক্ষমতাবাণ হয়ে ওঠতে চায় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, কিন্তু আসলে ক্রমাগত সে তার নিজেরই ক্ষমতার দাস হয়ে ওঠে।”
.
আমার জানামতে, যে কারোর যে কোনো লিখাই মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশ করা হয় না। মুক্তমনা ব্লগ আর তার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই এমন বিকৃত লেখা ব্লগে রেখে প্রমাণ করেছেন, তারা আসলে মুক্তচিন্তার নামে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে অশ্লীলতা আর বিকৃতমনষ্কতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন।
.
আসলে ইনসেস্ট কেন ঠিক নয় সেটা নিয়ে আমার মনে হয় না কোনো কিছু লেখার প্রয়োজন আছে। যে কোনো বিকৃতিহীন মানুষের কাছেই এটা কল্পনার অযোগ্য।
ইনসেস্টের কারণে “Inbreeding” ঘটে। যার ফলে পরবর্তী প্রজন্মে বিভিন্ন জেনেটিক ডিজঅর্ডার ঘটে থাকে।
.
এমনকি, বিবর্তনবাদও ইনসেস্ট থেকে সতর্ক করে। কারণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ইনব্রিডিং ঘটলে একটি প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে[১৮]। অনেকেই প্রশ্ন করেন, ইনব্রিডিং তো কাজিনদের বিয়ে করলেও ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামে কেন তাহলে কাজিনদের বিয়ে করার বৈধতা দিয়েছে?
.
একেবারে রক্তের সম্পর্কের কারো সাথে আমাদের ৫০% জীন কমন থাকার সম্ভাবনা আছে। যার ফলে খুব সহজেই ইনব্রিডিং ঘটে। কিন্তু কাজিনদের ক্ষেত্রে এটা কেবল ১২.৫%, অনেক কম[১৯]। এতোটুকু সম্ভাবনা অন্য যে কোনো শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হতে পারে।
.
কাজিনদের বিয়ের ক্ষেত্রে যতোটুকু ঝুঁকি রয়েছে তা আরো সহজেই এড়ানো যাবে, যদি আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাজিনদের বিয়ে না করি। আর এমনটা না করার পরামর্শ রাসূল(সাঃ) আমাদের দিয়ে গিয়েছেন[২০]।
.
পাশ্চত্যের বিভিন্ন পরিবারের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। যেখানে দেখানো হয়ঃ ভাই-বোন, মা-ছেলে কিংবা বাবা-মেয়ে বিয়ে করে একসাথে নাকি সুখী(!) সংসার যাপন করছে।
.
বাস্তবতা কিন্তু একেবারে আলাদা কথা বলে। যেসব পরিবারে এসব বিকৃতি ঘটে থাকে তাদের মধ্যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকে না[২১]। ঝগড়া, এলকোহল, ড্রাগ ইত্যাদি একদম নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়[২২]। যেসব মেয়ে তাদের পিতার দ্বারা এই অযাচারের শিকার হয় তাদের অনুভূতিতে চরম রাগ, ঘৃণা, অবিশ্বাস, ভয় আর লজ্জা মিশে থাকে[২৩]।
.
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, “Incest Taboo” কে ছুড়ে ফেলার মাধ্যমে মানবসমাজ বিকৃতির চরমে পৌঁছাচ্ছে। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে নিজেকে পশু-পাখির চেয়েও নীচের কাতারে নামাচ্ছে। ডক্টর জেফরী খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে সিগমুন্ড ফ্রয়েড একটি রূপকথাকে আমাদের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন[২৪]। তিনি এর নাম দিয়েছেন “The Real Oedipal Complex”। ইডিপাস কখনোই নিজের বাবাকে হত্যা করতে চায়নি, মার সাথে মিলিত হতে চায়নি। সে চেয়েছে এই কুৎসিত পরিণতি থেকে বাঁচতে। কিন্তু সে তার ভাগ্য থেকে বাঁচতে পারেনি। মানুষ কখনোই তার পরিবারের প্রতি কামুক হয়ে জন্মায় না। বরং এগুলো যে স্বাভাবিক না, এই বোধ নিয়েই সে জন্মায়।
.
আমার খুব অবাক লাগে এই বিকৃত যৌনাচারের জয়গান গাওয়া মানুষগুলোই আবার প্রশ্ন তুলে- কেন আমাদের নবী(সাঃ) নিজের ছেলের বউকে বিয়ে করেছিলেন?(মিথ্যা দাবী) কেন সাফিয়া(রাঃ) কে ধর্ষণ করেছিলেন?(আরেকটি মিথ্যা দাবী) তারা বলে আমাদের নবী শিশুকামী ছিলেন।(ভিত্তিহীন)
.
মানুষকে মুক্তির দীক্ষা দেয়ার দাবিদার মানুষগুলো তাদের কুৎসিত চিন্তা দ্বারা এতোটাই পরিবেষ্টিত যে; আজ তারা নিজেদের মাকে মা ভাবতে পারছে না, বোনকে বোন ভাবতে পারছে না। জীবন মানেই তাদের কাছে “Sex & Drugs & Rock & Roll”। পুরো দুনিয়াটাই তাদের কাছে “Sex Object”।
.
দিনশেষে এই মানুষগুলোই যে আলোকে অন্ধকার ভাববে, সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তাতে কি খুব বেশী অবাক হবার মতো কিছু আছে?
.
“In their hearts is disease, so Allah has increased their disease; and for them is a painful punishment because they [habitually] used to lie.” [ Al Quran 2:10]
——————-
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন
#সত্যকথন
———————
তথ্যসূত্রঃ
১। Inbreeding, Incest, and the Incest Taboo, Edited by Arthur P. Wolf and William H. Durham. (Page -23)
২। Max Planck Institute for Foreign and International Criminal Law , 14 March 2008. Retrieved 30 August 2012.
৩। http://www.independent.co.uk/…/german-ethics-council-calls-…
৪। Pusey and Wolf, “Inbreeding avoidance in animals,” (Page 202-205)
৫। Konrad Lorenz, “Der Kumpan in der Umwelt des Vogels,” Journal fürOrnithologie, vol. 83 (1935), (Page. 137–213, 289–413.)
৬। মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কি ক্ষতি হলো?- সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদবী (পৃষ্ঠা-৮০-৮১)
৭। Holy Bible: Leviticus 18:6-12, Leviticus 18:10, Leviticus 18:12-14, Deuteronomy 27:20-23
৮। Holy bible: Genesis 19:30-38
৯। Holy bible: Genesis 20:12
১০। Holy bible: 2 Samuel 13
১১। Holy bible: 2 Samuel 16
১২। S. K. Weinberg, Incest Behavior (New York: Citadel).
১৩। https://www.theatlantic.com/…/america-has-an-incest…/272459/
১৪। Incest: India’s ugly secret tumbles out in series of cases- https://www.youtube.com/watch?v=vA61xBnVb14&t=1s
১৫। Lawrence Krauss vs Hamza Tzortzis – Islam vs Atheism Debate

১৬। https://twitter.com/richarddawki…/status/312320023035273216…
১৭। https://blog.mukto-mona.com/2012/07/23/27550/
১৮। Bateson, “Optimal outbreeding,” in Mate Choice, ed. P. Bateson (Cambridge: Cambridge University Press, 1983), Page. 257–77.
১৯। Inbreeding, Incest, and the Incest Taboo, Edited by Arthur P. Wolf and William H. Durham. (Page -39)
২০। Why are first cousin marriages allowed in Islam? by Dr. Zakir Naik

২১। Herman, Father-Daughter Incest, p. 71.
২২। Kathleen C. Faller, “Women who sexually abuse children,” Violence and Victims, vol. 2 (1987), pp. 263–75;
২৩। Patricia Phelan, “Incest and its meaning: The perspectives of fathers and daughters,” Child Abuse and Neglect, vol. 19 (1995), pp. 7–24.
২৪। https://www.psychologytoday.com/…/…/the-real-oedipal-complex

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *