সাফিয়া(রাঃ)- নিপীড়িত যুদ্ধবন্দীনি নাকি সম্মানিত উম্মুল মুমিনীন ? [শিহাব আহমেদ তুহিন]

সাফিয়া(রাঃ)- নিপীড়িত যুদ্ধবন্দীনি নাকি সম্মানিত উম্মুল মুমিনীন ?
.
একই গল্প একটু অন্যভাবে বললে পুরো গল্পটাই বদলে যায়। আবার মাঝে মাঝে অন্যভাবে বলার ও প্রয়োজন নেই। শুধু প্রসঙ্গটা গোপন রাখতে পারলেই হলো- প্রসঙ্গবিহীন গল্প পড়ে একেবারে ঝানু পাঠক ও বোকা বনে যেতে পারে। এজন্য যখন আমরা ইতিহাস পড়ি তখন অবশ্যই উচিৎ প্রসঙ্গসহ পুরো ঘটনাটা পড়া। পড়ার পর যদি কোন কিছু গ্রহণযোগ্য মনে না হয় সেখানে আমাদের দেখতে হবে সমালোচকরা ব্যাপারটা নিয়ে কি বলেন, তারপর দেখা উচিৎ অপরপক্ষ ব্যাপারটা নিয়ে কি বলে। এভাবে যদি আমরা ইতিহাস না পড়ি তবে আমরা কেবল তাই ই দেখতে পাব যা আমাদের মন দেখতে চায় কিংবা সমালোচকরা আমাদের দেখাতে চায়। একটা উদাহারণ দেই। ধরা যাক, কেউ এসে আপনাকে বলল-
“ আনিস সাহেব রাতের বেলায় এক যুবতী নারীর বাসায় গেলেন। নারীটি তখন বাড়িতে একা ছিল।”
.
এই দুই লাইন পড়ে প্রায় সবাই ই মনে করবে আনিস সাহেব খুবই বাজে লোক। সে রাতের বেলায় যুবতী মেয়ের সাথে মজা লুটে। কিন্তু কেউ ভালোমত খোঁজখবর নিয়ে গল্পের প্রসঙ্গটা জানতে পারল। গল্পটা তখন এমন হলো-
“আনিস সাহেব একজন দয়ালু লোক। পাশের বাড়ীর এক যুবতী মেয়ে সদ্যই বিধবা হয়েছে। তাকে দেখাশুনার কেউ নেই। আনিস সাহেব তাই রাতের বেলায় মেয়েটিকে কিছু অর্থ দান করতে গেলেন।”
.
দেখলেন তো! প্রসঙ্গটা জানার পর পুরো গল্পটাই কেমন বদলে গেল! এখন এই গল্প পড়ে সমালোচকরা হয়তো বলতে পারে, ‘আনিস সাহেব কেন রাতের বেলায় যাবেন? তিনি কি দিনের বেলায় যেতে পারতেন না?’ আপনি দেখলেন অপরপক্ষ বলছে, ‘আনিস সাহেব সপ্তাহে সাত দিনই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। তার নিশ্বাস ফেলার ও সময় থাকে না। তাই রাতে যাওয়া ছাড়া তার উপায় নেই।
.
আপনি দুই পক্ষের মত আর প্রসঙ্গসহ আনিস সাহেবের গল্প পড়ে ফেললেন। এখন তাকে বিচার করার দায়িত্ব আপনার! আজ আমরা ঠিক এই কাজটাই করব। দুইজন মানুষের গল্প জানব দুইপক্ষের মতসহ, প্রসঙ্গসহ। তাঁরা হলেন মুহম্মাদ (সাঃ) ও সাফিয়া(রাঃ)।
.
কে ছিলেন সাফিয়া(রাঃ) ?
.
সাফিয়া(রাঃ) ছিলেন ইহুদী গোত্র বনু নাদীরের প্রধান হুয়াই বিন আখতারের কন্যা। বাবার বেশ আদরের মেয়ে ছিলেন উনি। তাঁর বর্ণনায়ঃ
“আমি ছিলাম আমার বাবা এবং আমার চাচাদের প্রিয় সন্তান। যখন আল্লাহর রাসূল ﷺ মদীনাতে আসলেন এবং কুবাতে অবস্থান করলেন, আমার বাবা তাঁকে রাতের বেলায় দেখতে যান। যখন তাঁরা ফেরত আসে তাদেরকে খুব চিন্তিত আর ক্লান্ত লাগছিল। আমি আনন্দের সাথে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানালাম কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম তাদের কেউই আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। তারা এতোটাই চিন্তিত ছিলেন যে তারা আমার উপস্থিতিই অনুভব করল না। আমি শুনতে পারলাম আমার কাকা,আবু ইয়াসির, আমার আব্বাকে বলছেন, ‘উনিই কি সেই ব্যক্তি?’ আব্বা জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’ আমার কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সত্যিই তাকে চিনতে পেরেছেন এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন আমার কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তার ব্যাপারে এখন আপনার চিন্তা-ভাবনা কি?’ তিনি বললেন, “আমি যতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকব তাঁর শত্রু হবো।’ [১]
.
আরবের ইহুদিরা তখন একজন নবীর অপেক্ষা করছিল। । ‘উনি কি সেই ব্যক্তি বলতে’ তাদের সেই নবীর কথাই বলা হয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যেত, যখনই কোন আরব গোত্রের সাথে ইহুদিদের ঝগড়া হতো তখন তারা আরবদের এই বলে হুমকি দিত, “যখন আমাদের প্রতিশ্রুত নবী আসবে তখন আমরা তোমাদের দেখে নিব।”
>>তাওরাতে সেই নবীর কিছু চিহ্ন বলে দেয়া ছিলঃ-
‘তিনি জেন্টাইলদের(যারা ইহুদী নয়) মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি কখনো চিৎকার করবেন না, তাঁর স্বরও উঁচু করবেন না, আর কখনো রাস্তাঘাটে তাঁর কন্ঠস্বর শোনাবেন ও না।’[২]
সীরাত গ্রন্থ পড়লে জানা যায়, রাসূল(সাঃ) বেশ নরম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো চিৎকার করে কথা বলতেন না। বাজারে তাঁর স্বর উঁচু করতেন না। [৩]
.
আবার সরাসরি সেই নবীর নামও বলে দেয়া হয়েছেঃ
חִכּוֹ, מַמְתַקִּים, וְכֻלּוֹ, מַחֲמַדִּים; זֶה דוֹדִי וְזֶה רֵעִי, בְּנוֹת יְרוּשָׁלִָם.
– ‘তাঁর মুখের ভাষা বড়ই মিষ্টি, হ্যাঁ! সে বড়ই প্রেমময়। হে জেরুজালেমের কন্যারা! সে হচ্ছে আমার প্রিয়জন, সে হচ্ছে আমার বন্ধু(হাবীব)।”[৪]
এখানে বড়ই প্রেমময় কথাটার হিব্রু “מחמד” উচ্চারণ করলে হবে ‘Mahammad-im’। হিব্রুতে ‘im’ ব্যবহৃত হয় ‘Plural of respect’ হিসেবে।
.
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইহুদিদের কিতাবে বেশ ভালোভাবেই মুহম্মদ ﷺ এর নাম ও বৈশিষ্ট্য লিখিত ছিল। কিন্তু ইহুদিরা আশা করেছিল তাদের মধ্যে থেকেই সেই নবীর আবির্ভাব ঘটবে। তাই যখন আরবদের মধ্যে থেকে সে নবীর আবির্ভাব ঘটল তখন তারা সেটা মেনে নিতে পারল না। অনেকের কাছে এটা অবাক লাগতে পারে কিন্তু ইহুদিদের ইতিহাসই এমন। যাকে তারা প্রায় সবাই নবী বলে মেনেছিল সেই মূসা(আঃ) এর ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই তারা বিদ্রোহ করেছিল। মুসা(আঃ) বেশ আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন,
“যতদিন ধরে আমি তোমাদেরকে চিনি ততদিনই তোমরা ঈশ্বরের সাথে বিদ্রোহ করে এসেছ।”[৫]
.
তাই সাফিয়া(রাঃ) এর বাবা মুহাম্মদ ﷺ কে নবী হিসেবে চিনতে পারলেও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অটল রইলেন। তবে সাফিয়া(রাঃ) এর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, তিনিই সেই প্রতিক্ষীত নবী। এদিকে খন্দকের যুদ্ধে ইহুদিরা কুরাইশদের সহযোগিতা করে চূড়ান্ত বিশ্বাস-ঘাতকতা করল এবং রাসূল ﷺ এর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করল। মক্কার মুশরিকদের সাথে হাত মিলিয়ে বনু কোরাইজা আর খায়বারের ইহুদিরা মুসলিমদের বেশ ভুগিয়েছিল। তাই রাসূল ﷺ খন্দকের যুদ্ধের পর খায়বারে অভিযান প্রেরণ করলেন। যুদ্ধে ইহুদিরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হলো।
সাফিয়া (রাঃ) এর বাবা, স্বামী মুসলিমদের হাতে মারা গেলেন, তিনি নিজে বন্দী হলেন। ইসলামে অবশ্যই ঢালাওভাবে যুদ্ধবন্দী করার উপায় নেই, এর কিছু নিয়ম আছে। এখানে এতো বিস্তারিতভাবে আলোচনা সম্ভব না। যারা ইসলামে দাসপ্রথা নিয়ে জানতে ইচ্ছুক তারা এই লেখাটি পড়তে পারেন[৬]।
ইন শা আল্লাহ চলবে
===============================
তথ্যসূত্রঃ
[১] Ibn Hisham, As-Sirah an-Nabawiyyah, vol. 2, pp. 257-258
[২] Holy Bible, Isaiah, 42 :1-2
[৩] When the Moon split-Shafiur Rahman Mubarakpuri,page-319
[৪] Holy Bible, Song of Solomon 5:16
[৫] Holy Bible, Deuteronomy 9:24
[৬] http://www.quraneralo.com/islam-and-slavery/
================================
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *