আমরা এখন যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা প্রসঙ্গসহ সমালোচকদের দৃষ্টিতে দেখব, এরপর যুক্তিগুলো খন্ডনের চেষ্টা করবঃ
.
রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে বিয়ে করলেনঃ
.
সাফিয়া(রাঃ) কে নিয়ে মিথ্যাচারের জন্য ইসলাম-বিদ্বেষীরা বুখারী শরীফের একটি হাদীস প্রায়ই ব্যবহার করে থাকে। হাদীসটিতে সামান্য কিছু কথা যোগ করলে আর প্রসঙ্গ বাদ দিলে রাসূল ﷺ খুব সহজেই একজন নিষ্ঠুর মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় বলে এটি ইসলাম-বিদ্বেষী মহলে খুব জনপ্রিয় একটি হাদীসঃ
.
আনাস ইবনে মালিক(রাঃ) থেকে বর্ণিত, “আমরা খায়বার জয় করলাম। তখন যুদ্ধবন্দীদের সমবেত করা হল। দিহয়া এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী ﷺ! বন্দীদের মধ্যে থেকে আমাকে একটি দাসী দিন।’ তিনি বললেন, ‘যাও তুমি একটি দাসী নিয়ে যাও।’ তিনি সাফিয়া বিনত হুয়াই(রাঃ) কে নিলেন। তখন এক ব্যক্তি নবী(সাঃ) এর কাছে এসে বললঃ ইয়া নবী! বনু কোরাইজা ও বনু নাযীরের অন্যতম নেত্রী সাফিয়্যা বিনত হুয়াইকে আপনি দিহয়াকে দিচ্ছেন? তিনি তো একমাত্র আপনারই যোগ্য। তিনি বললেনঃ
.
দিহয়াকে সাফিয়াসহ ডেকে আন। তিনি সাফিয়াসহ উপস্থিত হলেন। যখন নবী ﷺ সাফিয়াকে দেখলেন তিনি(দিহয়াকে)বললেনঃ তুমি বন্দীদের মধ্যে অন্য একজন দাসীকে বেছে নাও। রাবী বলেনঃ নবী ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে আযাদ করে দিলেন এবং তাঁকে বিয়ে করলেন। রাবী সাবিত(রাঃ) আনাস(রা:) কে জিজ্ঞেস করলেনঃ তিনি তাঁকে কি মোহর দিয়েছিলেন? আনাস(রাঃ) জবাব দিলেনঃ তাঁকে আযাদ করাই তাঁর মাহর। এর বিনিময়ে তিনি তাঁকে বিয়ে করেছেন।[১]
.
মুহম্মাদ ﷺ কি সাফিয়া(রাঃ) এর রুপে আসক্ত হয়ে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন?
অনেকে বলতে চান যে, হাদিসটিতে বলা আছে, রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে দেখে নিজের জন্য পছন্দ করেছেন, অর্থাৎ রূপ দেখে পাগল হয়েছেন। কিন্তু আরেকটু পিছনে পড়লেই আমরা দেখতে পারি এটা কোন কারণই ছিল না। এক ব্যক্তি যখন রাসূল ﷺ এর কাছে এসে বলল, ‘বনূ কুরাইযা ও বনূ নাযীরের অন্যতম নেত্রী সাফিয়্যা বিনত হুয়াইকে আপনি দিহয়াকে দিচ্ছেন’-তখন রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে ডেকে পাঠান। গোত্র প্রধানের মেয়ে এবং নেত্রী হিসেবে তিনি মুসলিমদের নেতার সাথেই বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত। তাই রাসূল(সাঃ) তাকে বিয়ে করেন। যদি এই ব্যক্তিটি এসে এমনটা বলত, ‘বনূ কুরাইযা ও বনূ নাযীরের সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে আপনি দিহয়াকে দিচ্ছেন’ আর এরপর রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ) কে ডেকে নিয়ে এসে বিয়ে করতেন, তাহলে মুহাম্মদ ﷺ এর দিকে এই অভিযোগ তোলা যেত।
.
এছাড়া আরবে একটি রীতি ছিল শত্রু যদি গোত্রের কোন মেয়েকে বিয়ে করত তবে তার সাথে তারা শত্রুতা শেষ করে ফেলত। এ কারণেই আবু সুফিয়ানের মেয়ে উম্মে হাবীবাহ(রাঃ) কে রাসূল ﷺ বিয়ে করার কারণে তাঁর সাথে আবু সুফিয়ানের শত্রুতা শেষ হয়ে যায়। রাসূল ﷺ এই বিয়ের মাধ্যমে ইহুদীদের সাথে শত্রুতা শেষ করার জন্য একটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সাফিয়া(রাঃ) কে তার সাথী এক মহিলা সহ বিলাল(রাঃ) রাসূল ﷺ এর কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে, স্বজাতি ইহুদিদের লাশ দেখে তাঁর সাথী মহিলা চিৎকার জুড়ে দিল। সাফিয়া(রাঃ) এসে রাসূল ﷺ এর পিছনে নিজেকে অত্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে দাঁড়ালেন। রাসূল ﷺ তাঁর উপর নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। তখন উপস্থিত মুসলিমরা বুঝে নিল যে, রাসূল(সাঃ) তাঁকে তাঁর নিজের জন্য পছন্দ করেছেন। রাসূল ﷺ এরপর বিলাল(রাঃ) কে তিরষ্কার করে বললেন, ‘তোমার হৃদয় থেকে কি দয়া-মায়া উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল হে বিলাল! তুমি এই দুই মহিলাকে তাদের আত্নীয়-স্বজনের দেহ মাড়িয়ে নিয়ে এলে?’ [২] ।
.
আর বিয়ের আগে সব মুসলিমই তার হবু বধূকে দেখে। এটা রাসূল ﷺ এর নির্দেশ। এর ফলে পুরুষের হৃদয়ে স্ত্রীর জন্য ভালবাসা সৃষ্টি হয়। শুধু ইসলাম না বরং সব ধর্ম আর সংস্কৃতিতে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে এতো লাফালাফি করার কারণ আমার নিকট পরিষ্কার না।
.
পিতা ও স্বামীর হত্যাকারীকে কেউই বিয়ে করতে চাইবে না। তাই সাফিয়া(রাঃ) কি বিয়েতে রাজী ছিলেন?
.
পিতা এবং চাচার কথা-বার্তায় সাফিয়া(রাঃ) এর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, মুহাম্মদ(সাঃ) ই তাদের প্রতীক্ষিত নবী। এছাড়া সাফিয়া(রাঃ) খায়বার বিজয়ের পূর্বে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেন। সাফিয়া(রাঃ) এর চোখের উপর ভাগে আঘাতের চিহ্ন ছিল। প্রথমবার যখন সাফিয়া(রাঃ) রাসূল ﷺএর সামনে উপস্থিত হন তখন নবী ﷺ তাঁকে এই আঘাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। সাফিয়া(রাঃ) তখন তাঁর স্বপ্নের কথা বর্ণনা করেন-
‘একবার আমি স্বপ্ন দেখলাম আকাশ থেকে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র এসে আমার কোলে পড়ল। আমি এর তাৎপর্য বুঝতে না পেরে আমার স্বামীকে স্বপ্নের কথা বললাম।
.
শুনে তিনি ক্ষুদ্ধ হলেন, ক্রদ্ধ হলেন আর বললেন, ‘কি! হিজাজের বাদশাহকে স্বামীরূপে পেতে তোর কামনা!’ আর তাই তিনি স্বপ্নে তোমার কোলে এসে পড়েন। এই না বলে তিনি আমার মুখে কষে দিলেন এক থাপ্পড়। আঘাতের সেই চিহ্নটি রয়ে গেছে মুখের উপর।’ [৩]
.
সাফিয়া(রাঃ) এর মানসিক অবস্থা তখন বেশ নাজুক ছিল। একদিক থেকে তিনি জানতেন মুহাম্মদ(সাঃ) ই সত্য নবী, অন্যদিকে নিজের পিতা এবং স্বামীকে হারনোর কারণে তিনি মুহাম্মদ(সাঃ) কে দায়ী করছিলেন। এ কারণে তার অন্তরে তৈরী হয়েছিল মুহাম্মদ(সাঃ) এর প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ। সাফিয়া(রাঃ) নিজেই তাঁর সেই অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেনঃ
.
‘আমার নিকট রাসূল(সাঃ) অপেক্ষা ঘৃণ্য আর কেউই ছিল না। কারণ উনি আমার পিতা ও স্বামীকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু নবী(সাঃ) তাকে বোঝালেন, ‘হে সাফিয়া! তোমার পিতা পুরো আরবকে আমার বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছিল এবং সে এটা এবং এটা করেছিল……।’ এভাবে তিনি বোঝাতে থাকলেন এবং (ঘৃণার) সেই অনুভূতিটা আমার মাঝ থেকে দূর হয়ে গেল।’ [৪]
.
এই হাদিসের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, পিতা ও স্বামীকে হারানোর কারণে তার মাঝে যে সহজাত ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিল তা মুহাম্মদ ﷺ যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করে দূর করে দেন। ধরা যাক, আপনি জানতে পারলেন বিচারক আপনার পিতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আপনার প্রথমে প্রচণ্ড রাগ লাগবে।কারণ, প্রত্যেকটা মানুষই তাদের কাছের মানুষদের নিরপরাধ ভাবতে ভালবাসে। কিন্তু যখন আপনি জানতে পারবেন যে, আপনার পিতা এক ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে আর এর জন্য তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য, তখন আর আপনার আগের মত ক্রোধ কাজ করবে না।
.
বন্দী হিসেবে কি তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্দীদের নিজেদের মতামতের কোন মূল্য থাকে না। সাফিয়া(রাঃ)কে কি জোর করেই বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছিল? ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে-
.
“যখন সাফিয়া(রাঃ) রাসূল ﷺ এর সামনে আসলেন তখন নবী(সাঃ) তাঁকে বললেন, ‘ইহুদিদের মধ্যে তোমার পিতা ততক্ষণ পর্যন্ত আমার সাথে শত্রুতা বন্ধ করেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তাকে ধ্বংস করেছেন।’ সাফিয়া(রাঃ) জবাবে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর কিতাবে বলেছেন, ‘কেউই অপরজনের পাপের ভার বহন করবে না [তিনি মূলত বাইবেলের একটা verse উদ্ধৃত করলেন- Ezekiel 18:20]’।
.
তখন রাসূল ﷺ তাঁকে বললেন, ‘Make your choice! তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর তবে আমি তোমাকে নিজের জন্য বেছে নিব। আর যদি তুমি ইহুদি থাকাটাকেই বেছে নাও তবে আমি তোমাকে মুক্ত করে দিব এবং তোমাকে তোমার লোকজনের নিকট পাঠিয়ে দিব। সাফিয়া(রাঃ) জবাবে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে আসার পর আপনি আমাকে দাওয়াত দেবার আগেই আমি ইসলামকে গ্রহণ করেছি আর আপনাকে সত্য বলে মেনেছি। ইহুদিদের মাঝে আমার কোন অভিভাবক নেই, বাবা নেই, কোন ভাই ও নেই। আমি ইসলামকে কুফরের উপর প্রাধান্য দিলাম। মুক্ত হয়ে আমার লোকজনের নিকট যাবার চেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই আমার নিকট অধিক প্রিয়।’ [৫]
.
ইন শা আল্লাহ চলবে
============================
তথ্যসূত্রঃ
[১] সহীহ বুখারী, খন্ড ১ অধ্যায় ৮ হাদীস নং ৭৬৩
[২] সীরাত ইবনে হিশাম, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৩
[৩] যাদুল মা’আদ-হাফিজ ইবনুল কাইয়্যুম,পৃষ্ঠা-৩১৫
[৪] সিলসিলা সহীহাহ-আলবানী, হাদীস নং-২৭৯৩
[৫] ইবনে সা’আদ, ৮/১২৩
============================
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন
Leave Your Comments