উপলব্ধি
.
ভার্সিটি পরীক্ষার আগের সেই মন্থর সময়কার ঘটনা। এক রাতে সারারাত জেগে জেগে দেখলাম একজন নাস্তিক আর মুসলিমের মধ্যকার একেবারে ওয়ার্ল্ডক্লাস বিতর্ক। মুসলিম ভাইটি বোঝান কেন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া সম্ভব ছিল না কিছুই, আবার নাস্তিক সাহেব দাবি করেন যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাখ্যায় সৃষ্টিকর্তার কোনও প্রয়োজন নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
.
একবার এই পক্ষ আর আরেকবার ওই পক্ষের দুর্বার বিতর্কে ভন ভন করতে লাগল আমার মাথা। একবার মনে হয় ‘আয় হায়, মুসলিম ভাইটা তো হেরে যচ্ছে!” আবার মনে হয় “হায় হায়! নাস্তিকের এই প্রশ্নের জবাব কী হবে?” পরে ঠিকই আবার জবাব নিয়ে আসেন মুসলিম ভাইটি। প্রায় ২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধ সময় কাটল।
.
অবশেষে বিতর্ক যখন শেষ প্রায় তখনই ফজরের আযান হল। ঢুলু ঢুলু চোখ আর ভন ভন মাথা নিয়ে অযু করে একরকম টলতে টলতে শেষপর্যন্ত মাসজিদে গিয়ে পৌঁছেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
.
এরপর ঘটেছিল আমার জীবনের আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা যা প্রকাশ করলেও অপ্রকাশ্যই রয়ে যাবে। যা এতদিন ছিল কেবলই আমার আর আমার রব্বের মাঝে। যা হয়েছিল তা হলঃ আমার মাথায় শুধু ঘুরছিল ডিবেটের সমস্ত কথাবার্তা। এইটা এরকম হলে ওইটা ওইরকম, তারমানে হল এই… আরও কত কী! সালাতে মনোযোগ দিত খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এরই মধ্যে ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত শেষ করে ফেললেন। এরপর শুরু করলেন –
.
‘আম্মা ইয়াতা সা-আলুন
‘আনিন নাবাইল আযীম
আল্লাযিহুম ফিহী মুখতালিফুন
কাল্লা সায়া’লামুন
সুম্মা কাল্লা সায়া’লামুন…
.
(১) তারা পরস্পরে কি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে?
(২) মহা সংবাদ সম্পর্কে,
(৩) যে সম্পর্কে তারা মতানৈক্য করে।
(৪) না, সত্ত্বরই তারা জানতে পারবে,
(৫) অতঃপর না, অতিসত্বরই তারা জানতে পারবে।
.
আরবি না বুঝলেও এই সূরা ‘নাবা’ এর অর্থ জানা ছিল। সাথে সাথে চোখ পানিতে ভিজে উঠল আমার। যেন আমার রব আমাকে উদ্দেশ্য করেই ইমাম সাহেবের মাধ্যমে শুনিয়ে দিচ্ছেন তাঁর বাণী।
.
মক্কার কাফিররা আখিরাতের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলত। করত মতানৈক্য, দেখাত যুক্তি-পাল্টা যুক্তি। আল্লাহ তাদের জবাব হিসেবে নাযিল করেছিলেন এই সূরা। সুবহানাল্লাহ! আজ ১৪০০ বছর পরও এইসব বিষয়ে মতানৈক্য আর বিতর্কের শেষ হয় নি। শেষ হবেও না। আর একইসাথে বদলে যাবে না আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের জবাব… আর থেমে থাকে নি আমার মত অধম কিছু বান্দাদেরকে এখনও সেই একই আয়াতগুলো দিয়ে একইভাবে উজ্জীবিত করা।
.
যার অন্তর যেমন সে ওইদিকেই ধাবিত হবে। আর শেষ পর্যন্ত ওই অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করবে। আর আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের পক্ষ থেকে যেমন নিদর্শনই আসুক না কেন তা কখনওই কিছু মানুষের সন্দেহের সীমা অতিক্রম করবে না। একটা না একটা অন্যরকম ব্যাখ্যা তাতে থাকবেই। শেষপর্যন্ত তা না দেখেই বিশ্বাস অর্থাৎ ‘গায়েবে বিশ্বাস’ – এতেই এসে যাবে। কারণ আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা এটাই চান যে তাঁর বান্দারা না দেখেই বিশ্বাস স্থাপন করুক।
.
“এ হল সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী তাকওয়া আওবলম্বনকারীদের জন্য, যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে…”(সূরা বাকারাহ, ২: ২-৩)
.
তাই আপনারা যারা জানতে চান সেদিনের সেই বিতর্কে শেষপর্যন্ত কে জিতেছিল তাদের বলি, কেউ জেতেনি। তর্কশাস্ত্রের একটি পন্থা হল নিজেকে রাজি করাতে বলে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকা। অর্থাৎ আগে থেকেই যে বিশ্বাস ছিল তাতেই শক্তভাবে অবস্থান করা। মক্কার কাফির-নাস্তিকরা তাই ১৪০০ বছর আগে যেমনিভাবে মানে নি, আজকের কাফির-নাস্তিকরাও তেমনিভাবেই মানবে না। ওদের মানানোর জন্য যদি চাঁদ পর্যন্ত দ্বিখণ্ডিত করা হয়, তাহলেও তারা বলবে এটা ছিল যাদু বা দৃষ্টিভ্রম ইত্যাদি ইত্যাদি।
.
তাই শেষপর্যন্ত বিষয়টা আপনার ওপরেই। কোন দলে ভিড়বেন আপনি? বিশ্বাসীদের দলে নাকি অবিশ্বাসীদের? থেকে যাবেন সংশয় সন্দেহে?
.
নাকি মাঝে মাঝে পেতে চাইবেন নিজের এমনসব মুহুর্ত যখন মনে হবে আপনার রব সরাসরি আপনার সাথে কথা বলছেন?
=====================
.
লেখক: তানভীর আহমেদ
Leave Your Comments