ইসলামে দাসপ্রথা ২
.
গত পর্বে ইসলামে দাসপ্রথা ও দাসমুক্তির ব্যাপারে ইসলামের যুগান্তকারী উপায়সমূহের ব্যাপারে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছিলো। এই পর্বে ইনশাআল্লাহ ইসলামে দাসপ্রথার স্বরুপ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
কুরআন কারীমে দাসদের সাথে কেমন আচরন করা হবে তার আলোচনা আছে কিন্তু কোথাও দাস বানানোর বিষয় উল্লেখ নেই। কুরআন কারীমের কোথাও স্বাধীন মানুষকে দাস বানানোর আদেশ নেই। তবে যেহেতু সরাসরি কুরআনে দাস বানানোর ব্যাপারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক আয়াত নেই তাই একে সরাসরি নিষেধ করার কোনো উপায় নেই।
.
ইসলাম পূর্ব সময়ে যে যে উপায়ে দাস বানানো যেত ইসলাম সেইসকল পথ বন্ধ করে দিয়েছে শুধুমাত্র একটি বাদে তা হলো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে যুদ্ধবন্দিদের দাস বানানো। অর্থাৎ যুদ্ধবন্দী ছাড়া ইসলামে দাস বানানোর আর কোনো উপায় বাকী নেই। তবে তাও বেশ শর্তসাপেক্ষে যা একটু পরেই উল্লেখ হবে। তার আগে জেনে নেই যে ইসলামে মূলত জিহাদ কী ও কেন??
.
ইসলামে জিহাদ বলতে আল্লাহর রাস্তায় কাফিরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা।
.
শায়খ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম তুওয়াইজিরী(রাহি) বলেন, “আল্লাহর কালেমা তথা তাওহীদকে উড্ডিন করার নিমিত্তে তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শক্তি ও প্রচেষ্টা ব্যয় করাকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বলে”[1]
.
জিহাদ মূলত বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।
.
১। ফিতনা দূরীভূত করা এবং দ্বীনকে পরিপূর্ণ ভাবে আল্লাহর জন্য করা(সূরা-আনফাল, ৮ঃ৩৯) এখানে ফিতনা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শিরক ও কুফর।
.
২। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য।
.
৩। মজলুম মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সাহায্য করা।(সূরা নিসা ৪ঃ৭৫)
.
৪। তাগুত অথবা জালিমের বিরুদ্ধে(সূরা নিসা ৪ঃ৭৬)
.
৫। আগ্রাসন রোধের জন্য(সূরা বাকারাহ ২ঃ১৯০)
.
মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে বের করে আল্লাহর গোলামীর দিকে নিয়ে যাওয়া, দুনিয়ার সংকীর্নতা থেকে আখিরাতের প্রশস্ততার দিকে নিয়ে যাওয়া, আর অন্যান্য দ্বীন বা মতবাদের অন্যায়-জুলুম থেকে ইসলামের ন্যায়বিচারের দিকে নিয়ে যাওয়াই ইসলামের জিহাদের মূল উদ্দেশ্য, যেমনটি বিখ্যাত সাহাবী রাবঈ ইবন আমর(রাদি) পারস্য সেনাপতি রুস্তকে বলেছিলো(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইফা, ৭/৭৭)
.
ইসলামী শরিয়াতের অনুমোদিত জিহাদে যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো যেতে পারে এই একটি রাস্তা ইসলাম খোলা রেখেছে তবে সেটিও শর্তসাপেক্ষে। জিহাদে যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে খলীফা নিম্নের ৪টি সিদ্ধান্তের যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করা যেতে পারে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থ ও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায়ঃ
.
(১) বন্দী করে অনুগ্রহ করে সবাইকে বিনা মুক্তিপনে ছেড়ে দেওয়া;[2] যেমনটি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের দিন করেছিলেন সেদিন সমস্ত ক্ষমতা, প্রতাপ, আধিপত্য মুসলিমদের হাতে থাকা সত্ত্বেও, আরব ভূখন্ডে ইসলাম পূর্ণতা পেলেও, মুসলিমদের পরিপূর্ন বিজয়ের দিন, যেদিন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ২৩ বছরের কত ব্যথার দগদগে স্মৃতিগুলোর প্রতিশোধ না নিয়েই সমস্ত কাফিরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিলো। কোথায় পাবেন এমন আদর্শ ইসলাম ছাড়া!!!!!!
.
(২) মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া;[3] যেমনটি রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদরের যুদ্ধের সময় করেছিলেন।
.
(৩) তাদেরকে হত্যা করা[4] যদিও এই সম্পর্কিত আয়াতটি নাযিল হয়েছিলো বদর যুদ্ধের সময়ে যেখানে বন্দীদের হত্যা না করে মুক্তিপন নিয়ে মুক্তি দিয়ে দেওয়ার জন্য মুসলিমদের তিরস্কার করা হয়েছে। কেননা বদর যুদ্ধ মুসলিমদের প্রথম যুদ্ধ ও অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে মুসলিমগন আল্লাহর ইচ্ছায় বিজয় লাভ করেছিলেন। সেই সময়ে বদর যুদ্ধের অবাধ্য কাফিরদেরকে শুধুমাত্র মুক্তিপন নিয়ে আবার মুসলিমদের বিপক্ষে আবার ষড়যন্ত্র করে ইসলামের দাওয়াতে বাধা সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়াটা কখনোই সুদক্ষ রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হতে পারেনা। তাই আল্লাহ মুসলিমদের এহেন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাদের তিরস্কার করে সাবধান করে দিয়েছিলেন যাতে প্রয়োজনের সময় দ্বীনের স্বার্থে মুসলিমরা কখনোই কঠোর হতে ভুলে না যায় এবং অবাধ্য কাফিরদের যাতে উপযুক্ত সাজা দেয়। তবে গাযওয়ায়ে বানু কুরাইযাতে রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবাধ্য ইয়াহুদী কাফিরদেরকে যারা বার বার চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্নভাবে মুসলিমদের কষ্ট দিচ্ছিলো তাদের বন্দী করে হত্যা করেছিলেন।[5] তবে তাও শুধুমাত্র দ্বীনের স্বার্থে।
.
(৪) তাদেরকে দাস বানিয়ে রাখা; উপরের তিনটি উপায়ের একটি ও যদি গ্রহনযোগ্য না হয়ে তবে মুসলিম খলীফা চাইলে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস বানিয়ে রাখতে পারে। তাদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে তাদের হক আদায় করে দাস হিসেবে রাখা যেতে পারে। দাস-দাসীদের অধিকার পর্বে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
.
তো উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে গেলো যে শরীয়তসম্মত জিহাদে খলীফা বা নেতা চাইলে বন্দীদের ব্যাপারে পরিস্থিতি মোতাবেক উপরোক্ত ৪টি সিদ্ধান্তের যেকোনো একটি গ্রহন করতে পারেন। তবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ১ ও ২নং এর যেকোনো একটি গ্রহনই আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। ইসলাম কখনোই শত্রুদের রক্তপিপাসু না যে পেলো আর ধড়াধড় মেরে গেলো। তবে দ্বীনের দাওয়াতে বাধা দানকারীদের ব্যাপারে দয়ার কোনো সুযোগও নেই। আর ৩টির একটিও যদি উপযোগী না হয় তবে খলীফা চাইলে যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস বানিয়ে রাখা যেতে পারে। এতে করে যা হবেঃ
.
(ক) যুদ্ধবন্দী যদি এমন হয় যে তার ফিরে গেলে মুসলিম উম্মাহর ও ইসলামের ক্ষতি করতে পারে বা পুনরায় ষড়যন্ত্র করতে পারে তাহলে তার ক্ষতি থেকে মুসলিমরা বেচে যাবে। এতে দ্বীনের দাওয়াত প্রসারিত হবে;
(খ) সবচেয়ে বড় উপকারীতা হলো মুসলিমদের সাথে বসবাস করতে করতে যদি কেউ ইসলামের সুমহান আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয় আর আল্লাহর ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহন করে নিজেকে অনন্তকালের জাহান্নাম থেকে বেচে যায় এর থেকে বড় সৌভাগ্যের ও মর্যাদার আর কিছুই হতে পারেনা;
.
(গ) আর যদি তা নাও হয় তবুও দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দাস-দাসী মনিবের সাথে মুকাতাবাত বা লিখিত চুক্তি করে নিতে পারে। মনিব এতে কল্যান দেখতে পেলে তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে নিলে সে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে;
.
প্রশ্ন হতে পারে যে, ইসলাম তাহলে কেন অন্যান্য সামাজিক ব্যাধির মতো এই দাসপ্রথাকে চিরবিলুপ্ত করে দেয়নি???
.
পূর্বেই আলোচনা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইসলামের আগমনই এমন সময় হয়েছে যখন দাসপ্রথার দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানের মতো ছিলোনা। দাসপ্রথার ওপর তখন অর্থনীতির ভিত্তি দাঁড়িয়ে ছিলো তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর শিকড় বিদ্যমান ছিলো তা ছিলো অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত শিকড়। তাই ইসলাম সেইসময়ে দাসপ্রথাকে পরিপূর্ন বিলুপ্ত করেনি এতে করে পুরো সমাজব্যবস্থাই মুখ থুবড়ে পড়তো যা ইসলামী দাওয়াত প্রসারের পথে প্রতিবন্ধকতা স্বরুপ দেখা দিতে পারত তাই ইসলাম তখন দাসপ্রথাকে পরিপূর্ন ভাবে বাতিল না করে দিয়ে এর সমাধানের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।
.
তাছাড়া ইসলামে জিহাদ যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া তাই সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যুদ্ধবন্দীদের দাসপ্রথা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ঘোষনা করেনি যাতে কাফিরদের মোকাবেলায় যাতে যুদ্ধনীতি বা রাজনৈতিক নীতিতে ইসলামে স্থবিরতা না থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জানেন আর আমরা খুবই কম জানি।
[চলবে ইন শা আল্লাহ]
…………………………………
[1] কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকহ, ২/৭৮৫
[2] সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ঃ৪
[3] সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ঃ৪
[4] সূরা আনফাল ৮ঃ৬৭
[5] আর রাহীকুল মাখতুম, গাযওয়ায়ে বানু কুরাইযাহ দ্রষ্টব্য
=====================
লেখকঃ হোসাইন শাকিল
Leave Your Comments